Travel ট্র্যাভেল টেক ২০২৫: এআই, স্মার্ট অবকাঠামো ও সবুজ প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে ভ্রমণের ভবিষ্যৎ

প্রতিবেদন: বিশেষ সংবাদদাতা
বিশ্ব ক্রমেই দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, আর ভ্রমণ শিল্প সেই পরিবর্তনের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে। ২০২৫ সালকে বলা হচ্ছে ভ্রমণ প্রযুক্তির (Travel Tech) এক নতুন অধ্যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR), স্মার্ট অবকাঠামো এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো পর্যটন খাতকে পাল্টে দিচ্ছে অভাবনীয় গতিতে। শুধু ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই নয়, যাত্রীর নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও ব্যক্তিগত চাহিদাও এ প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
এই প্রতিবেদনে ২০২৫ সালের ভ্রমণ প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবন, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
এআই: ভ্রমণ পরিকল্পনার সর্বজনীন সহকারী
২০২৫ সালের ভ্রমণ প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যাপক ব্যবহার। এখন আর ট্রাভেল এজেন্সিতে বসে টিকিট বুকিং কিংবা লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এআই-চালিত প্ল্যাটফর্ম ও ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট যাত্রীর ভ্রমণকে একদম ব্যক্তিগত করে তুলছে।
উদাহরণস্বরূপ, কাতার এয়ারওয়েজ ইতিমধ্যেই “সামা” (Sama) নামের একটি এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট চালু করেছে। এটি শুধু ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যই দেয় না, বরং যাত্রীর মুড বা অভিব্যক্তি বুঝে সেই অনুযায়ী পরামর্শও দেয়। ফলে ভ্রমণ হয়ে উঠছে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় ও ব্যক্তিগত।
এছাড়া DeepTravel ও TraveLLaMA নামের নতুন এআই মডেলগুলো যাত্রীর ভ্রমণ রুট, হোটেল বুকিং, আবহাওয়া এবং জনসমাগম বিবেচনা করে স্মার্ট ট্রিপ প্ল্যানিং করছে। এমনকি কোন পথে যানজট কম, কোন সময় দর্শনীয় স্থান কম ভিড় হবে—এসব তথ্যও তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেয়।
রিয়েল-টাইম ভাষান্তর: ভাষা আর বাধা নয়
অন্য দেশে গেলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয় ভাষা। স্থানীয় ভাষা না জানলে অনেক সময় যোগাযোগে সমস্যা হয়, যার ফলে ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ২০২৫ সালে এই সমস্যা প্রায় সমাধান হয়ে যাচ্ছে।
রিয়েল-টাইম ট্রান্সলেশন টুলস এখন স্মার্টফোন, ওয়্যারেবল ডিভাইস এমনকি এয়ারপোর্ট ও হোটেলের সেবা ব্যবস্থার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে গেছে। ফলে ভ্রমণকারীরা নিজের মাতৃভাষায় কথা বললেও অপর প্রান্তের মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে অনুবাদ পেয়ে যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তি শুধু যোগাযোগ সহজ করছে না, বরং নতুন সংস্কৃতিকে জানার সুযোগও বাড়াচ্ছে। একজন ভ্রমণকারী স্থানীয় বাজারে ঘুরতে গিয়ে বিক্রেতার সঙ্গে সহজে দরদাম করতে পারছেন, কিংবা স্থানীয় গাইডের কথাও মাতৃভাষায় বুঝতে পারছেন।
স্মার্ট অবকাঠামো ও IoT: ভ্রমণ আরও স্মার্ট
ভবিষ্যতের ভ্রমণ কেবল টিকিট বুকিং বা হোটেল রিজার্ভেশনেই সীমাবদ্ধ নয়। এখন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শুরু হচ্ছে বিমানবন্দরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে।
বিমানবন্দরে যাত্রী সেবায় IoT বা স্মার্ট ডিভাইস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্মার্ট লাগেজ ট্যাগ লাগানোর মাধ্যমে যাত্রীরা মোবাইল অ্যাপে রিয়েল-টাইমে তাদের ব্যাগেজ কোথায় আছে তা ট্র্যাক করতে পারছেন।
হোটেলগুলোও ক্রমেই স্মার্ট হয়ে উঠছে। “স্মার্ট রুম” কনসেপ্টে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই রুমের আলো, তাপমাত্রা এমনকি জানালার পর্দাও যাত্রীর পছন্দ অনুযায়ী সেট হয়ে যাচ্ছে। ভয়েস কমান্ড দিয়েই টিভি চালু বা খাবার অর্ডার করা সম্ভব হচ্ছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি
ভ্রমণের আগে অনেকেই জানতে চান কোন জায়গাটি দেখতে কেমন। এ জন্য ২০২৫ সালে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) একটি বড় উদ্ভাবন হয়ে উঠেছে।
ভ্রমণকারী এখন যাত্রার আগে VR গগলস ব্যবহার করে পুরো গন্তব্যের ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতা নিতে পারছেন। যেমন, প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রবেশের আগেই VR এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ দৃশ্য দেখে নেওয়া যায়। আবার AR অ্যাপের মাধ্যমে কোনো শহরের রাস্তায় হাঁটার সময় ফোনের স্ক্রিনে সেই স্থানের ইতিহাস বা তথ্য ভেসে ওঠে।
টেকসই ভ্রমণ: পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতা
আজকের বিশ্বে ভ্রমণ শিল্প শুধু আনন্দের নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধও। ২০২৫ সালের ভ্রমণ প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ বড় জায়গা করে নিয়েছে।
এয়ারলাইনগুলো ধীরে ধীরে বায়োফুয়েল বা টেকসই জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। হোটেলগুলোতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার, সৌরশক্তি নির্ভর বিদ্যুৎ, প্লাস্টিকমুক্ত ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।
Otto Aviation-এর Phantom 3500 জেট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। এতে প্রচলিত জানলা নেই, বরং ডিজিটাল স্ক্রিন রয়েছে যা বাইরের দৃশ্য দেখায়। এর ফলে বিমানের কাঠামো হালকা হয় এবং জ্বালানি খরচ কমে যায়, যা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।
বায়োমেট্রিক ও নিরাপত্তা
ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিমানবন্দরগুলো বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এখন পাসপোর্ট বা বোর্ডিং পাস না দেখিয়েও মুখের স্ক্যান দিয়ে ফ্লাইটে উঠা সম্ভব হচ্ছে।
এতে সময় বাঁচছে এবং নিরাপত্তা আরও জোরদার হচ্ছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ডেটা গোপনীয়তার প্রশ্ন, যা ভবিষ্যতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ: প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি শঙ্কাও
যদিও এসব প্রযুক্তি ভ্রমণকে সহজ করছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
- ডেটা প্রাইভেসি: যাত্রীর ব্যক্তিগত তথ্য সারাক্ষণ স্ক্যান বা ট্র্যাক হলে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
- অসামঞ্জস্য: উন্নত দেশগুলো দ্রুত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইন্টারনেট অবকাঠামো বা বাজেট ঘাটতির কারণে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে।
- মানবিক সংযোগ হারানো: অনেক যাত্রী চান ব্যক্তিগত সহায়তা, হাসিমুখে রিসেপশন বা বন্ধুত্বপূর্ণ গাইড। প্রযুক্তির বাড়তি ব্যবহার কখনো কখনো এই মানবিক স্পর্শ কমিয়ে দিতে পারে।
ভবিষ্যতের ভ্রমণ: প্রযুক্তি আর মানুষের সমন্বয়
২০২৫ সালের ভ্রমণ প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে ভ্রমণের ধারা পাল্টে দিচ্ছে। তবে এর সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে তখনই, যখন প্রযুক্তি আর মানুষের সহমর্মিতা একসঙ্গে কাজ করবে।
ভবিষ্যতের ভ্রমণ শুধু দ্রুত, আরামদায়ক ও নিরাপদই হবে না—বরং এটি পরিবেশবান্ধব, সংস্কৃতি-বান্ধব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলকও হবে।
উপসংহার
২০২৫ সালের ভ্রমণ প্রযুক্তি নিছক বিলাসিতা নয়, বরং মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি প্রতিচ্ছবি। এআই, VR, IoT, টেকসই জ্বালানি ও স্মার্ট অবকাঠামো মিলিয়ে এটি হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের ভ্রমণের ভিত্তি।
তবে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, ভ্রমণের আসল আনন্দ মানুষের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও সংযোগেই নিহিত। তাই বলা যায়—ভবিষ্যতের ভ্রমণ হবে প্রযুক্তি ও মানবিকতার এক অনন্য মিশ্রণ।