ব্লকচেইন: তথ্য সংরক্ষণে বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ঘটাচ্ছে নতুন প্রযুক্তি

ব্লকচেইন: তথ্য সংরক্ষণে বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ঘটাচ্ছে নতুন প্রযুক্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা | অক্টোবর ১৫, ২০২৫
ডিজিটাল দুনিয়ায় নিরাপদ তথ্য সংরক্ষণ ও লেনদেন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি হলো ব্লকচেইন। এটি এমন এক উদ্ভাবন, যেখানে তথ্য সংরক্ষণের জন্য কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হয় না। ফলে তথ্য হয় নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং বিকৃতিরোধী।
🔹
ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে
ব্লকচেইন মূলত একটি ডিজিটাল খাতা (Digital Ledger), যেখানে তথ্য বা লেনদেনের রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে ধারাবাহিকভাবে। প্রতিটি তথ্যের ব্লক (Block) যাচাইয়ের পর পরের ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়—এভাবে তৈরি হয় একটি দীর্ঘ “চেইন” বা শৃঙ্খল। তাই এর নাম Blockchain।
প্রতিটি ব্লকে থাকে:
- লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য,
- সময় ও তারিখ,
- এবং আগের ব্লকের ইউনিক কোড (হ্যাশ)।
এই কোডের কারণে কোনো ব্লকের তথ্য পরিবর্তন করলে পুরো চেইন অকার্যকর হয়ে যায়, যা প্রযুক্তিগতভাবে প্রায় অসম্ভব। ফলে এটি অত্যন্ত নিরাপদ ও স্বচ্ছ তথ্যব্যবস্থা।
🔹
বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা (Decentralization)
ব্লকচেইনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ, এটি কোনো একক সার্ভারে নয়, বরং হাজারো কম্পিউটার বা “নোড”-এ সংরক্ষিত থাকে। প্রতিটি নোড একই কপি রাখে, ফলে কেউ ইচ্ছেমতো তথ্য বদলাতে পারে না।
এই ব্যবস্থার কারণে ব্লকচেইনকে বলা হয় trustless system — এখানে বিশ্বাসের জন্য কোনো ব্যাংক, সরকার বা তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হয় না।
🔹
ব্লকচেইনের ব্যবহার ক্ষেত্র
শুরুতে ক্রিপ্টোকারেন্সি—বিশেষ করে বিটকয়েন (Bitcoin) লেনদেনের জন্য ব্লকচেইন ব্যবহৃত হলেও এখন এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে নানা খাতে:
- 💰 ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং: নিরাপদ ও দ্রুত আন্তর্জাতিক লেনদেন
- 🧾 জমি ও সম্পত্তির দলিল সংরক্ষণ: জালিয়াতি রোধ
- 🗳️ ভোটিং সিস্টেম: স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন
- 🏭 সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট: পণ্যের উৎস ট্র্যাক করা
- 📑 স্মার্ট কনট্রাক্ট: স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অধিকাংশ তথ্য ব্যবস্থাপনায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে।
🔹
বাংলাদেশেও আগ্রহ বাড়ছে
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইতিমধ্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সীমান্তপারের ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থায় ব্লকচেইন ব্যবহার করার সম্ভাবনা যাচাই করছে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা ও জমি নিবন্ধন খাতেও ব্লকচেইনভিত্তিক প্রকল্প চালুর আলোচনা চলছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “ব্লকচেইন প্রযুক্তি আমাদের সরকারি ডেটা ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করতে পারবে। ভবিষ্যতে সব নাগরিক সেবা এতে যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে।”
🔹
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ডিজিটাল সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ড. মাহমুদুল হাসান বলেন,
“ব্লকচেইন হলো আগামী প্রজন্মের তথ্যভিত্তিক অবকাঠামো।
এটি শুধু ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নয়, বরং পুরো প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো পাল্টে দিতে সক্ষম।”
তিনি মনে করেন, ব্লকচেইনের মাধ্যমে দুর্নীতি ও তথ্য বিকৃতির ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
🔹
ভবিষ্যতের দিগন্ত
বিশ্বব্যাপী বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন IBM, Microsoft, Amazon এখন ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অবদান হবে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে ধারণা করছে PwC।
বাংলাদেশও যদি সময়মতো প্রযুক্তিটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে, তবে ডিজিটাল সেবা খাতে এটি হতে পারে নতুন বিপ্লবের সূচনা।
🧭
সারসংক্ষেপ
ব্লকচেইন শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, বরং নিরাপদ ও স্বচ্ছ ভবিষ্যতের ভিত্তি। ব্যাংক, ভোট, জমির দলিল থেকে শুরু করে প্রতিদিনের লেনদেন—সব কিছুতেই এটি আনতে পারে আস্থা ও স্বচ্ছতা।
বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে এই প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে বুঝে ব্যবহার করার।