জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব: সংবিধান থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শন অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির চিন্তা

🟩 জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(ক)—যাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—তা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব বিবেচনা করছে।
এ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হতে পারে আসন্ন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’–এ, যা বর্তমানে চূড়ান্তকরণের পর্যায়ে রয়েছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ–এর স্বাক্ষরে বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠানো হয়, যেখানে বলা হয়—
“রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের সঙ্গে জুলাই সনদ ২০২৫ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নবিষয়ক বৈঠক শেষ হয়েছে। এখন কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(ক)-এ বর্ণিত বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাবটি সনদে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে।”
🟩 মতামত পাঠানোর শেষ সময়
চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে ১১ অক্টোবর শনিবার বিকেল ৪টার মধ্যে তাদের লিখিত মতামত কমিশনের কাছে পাঠাতে হবে।
মতামত পাঠানো যাবে কমিশনের ই-মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের মাধ্যমে। প্রয়োজনে সরাসরি যোগাযোগেরও সুযোগ রাখা হয়েছে।
🟩 এবি পার্টির প্রতিক্রিয়া
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,
“আমরা কমিশনের চিঠি পেয়েছি, তবে এখনো আনুষ্ঠানিক মতামত পাঠাইনি। দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। শিগগিরই আমাদের অবস্থান জানাব।”
তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশোধনের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
🟩 অনুচ্ছেদ ৪(ক): পটভূমি
২০১১ সালের ৩০ জুন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৪(ক) যুক্ত করে।
এই অনুচ্ছেদে বলা হয়—
“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সকল সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।”
এর ফলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শন রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
🟩 কেন বিলুপ্তির প্রস্তাব?
কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা না এলেও সূত্র বলছে, প্রস্তাবটির মূল উদ্দেশ্য হলো—
“রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে ব্যক্তি বা দলনির্ভর প্রতীক থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ নিশ্চিত করা।”
অধ্যাপক আলী রীয়াজ এক আলোচনায় বলেন,
“বাংলাদেশের সংবিধানকে এমনভাবে পুনর্লিখন করতে হবে যাতে তা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা আদর্শ নয়, বরং পুরো জাতির প্রতিফলন হয়।”
🟩 রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের এক নীতিনির্ধারক নেতা বলেন,
“বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রতিকৃতি সংবিধানে থাকা জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার শামিল।”
অন্যদিকে, বিরোধী মতের এক রাজনীতিকের ভাষায়—
“সংবিধান জনগণের দলিল, কারও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতীক নয়। রাষ্ট্রকে ব্যক্তি থেকে আলাদা করাই গণতন্ত্রের মূল চেতনা।”
🟩 সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদাত হোসেন মনে করেন,
“এই অনুচ্ছেদ মূলত প্রতীকী। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন অন্যভাবে হতে পারে, কিন্তু সংবিধানে বাধ্যতামূলক করে রাখার যৌক্তিকতা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।”
অন্যদিকে আইনবিদ আসিফ নজরুল বলেন,
“রাষ্ট্রের ইতিহাসকে সম্মান করা জরুরি, তবে সংবিধান কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতীক ধরে রাখতে পারে না। জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।”
🟩 জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বর্তমানে যে সনদ প্রণয়ন করছে, তা একটি নতুন জাতীয় রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে। এতে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন পদ্ধতি, মানবাধিকার, বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনিক সংস্কারসহ নানা প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির প্রস্তাব এখন এই সনদের সবচেয়ে আলোচিত অংশ।
🟩 ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নিয়ে সরাসরি কোনো উল্লেখ না থাকলেও, তাঁর নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের প্রচলন ছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়।
🟩 পরবর্তী ধাপ
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই প্রস্তাবটি ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়াতে অন্তর্ভুক্ত করবে কি না তা নির্ধারণ করবে।
কমিশনের এক সদস্য (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন,
“উদ্দেশ্য কারও ভাবমূর্তি খর্ব করা নয়, বরং এমন একটি সংবিধান তৈরি করা যাতে সব রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে পায়।”
🟩 উপসংহার
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বিলুপ্তির প্রস্তাব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে।
একদিকে এটি রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার পথে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে অনেকে বলছেন—এটি জাতির প্রতিষ্ঠাতা নেতার প্রতি অবমাননা।
এখন দেশের দৃষ্টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকে—
সংবিধান কি নতুন রূপে ফিরে আসবে, নাকি থেকে যাবে আগের ঐতিহ্যেই?
সময়ের অপেক্ষা।