এবার গুমের মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৮ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলমান থাকা অবস্থায় এবার গুমের মামলায়ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। বুধবার সকালে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল এ পরোয়ানা জারি করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা দুটি পৃথক গুমের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত শেখ হাসিনাসহ মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং সাবেক ও বর্তমান সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহু কর্মকর্তা।
দুটি মামলাতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র উপস্থাপন করেন। আদালত তা আমলে নিয়ে পরোয়ানা জারির আবেদন মঞ্জুর করেন। প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম সাংবাদিকদের বলেন, “গুমের প্রথম মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এই মামলায় পাঁচটি নির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।”
অপর মামলায় শেখ হাসিনা, তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ আরও ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায়ও পাঁচটি পৃথক অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে পরিকল্পিত গুম, নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী কর্মীদের নিখোঁজ করার অভিযোগ রয়েছে।
প্রথম মামলার আসামিরা
প্রথম গুমের মামলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক ছাড়াও আরও ১৪ জন সাবেক র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন।
- সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ
- র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন
- র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ
- কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কামরুল হাসান
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব আলম
- কর্নেল কে. এম. আজাদ
- কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) খায়রুল ইসলাম
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন
এই মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্দেশে শতাধিক রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীকে গুম করা হয়। অনেকেরই আজও কোনো খোঁজ মেলেনি।
দ্বিতীয় মামলার আসামিরা
দ্বিতীয় মামলায় শেখ হাসিনা, তারিক সিদ্দিক ছাড়াও আরও ১১ জন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন। এরা মূলত ডিজিএফআইয়ের (DGFI) সাবেক মহাপরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা।
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন
- মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী
- মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক
- মেজর জেনারেল মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম
- মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন
- মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক
এই মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ডিজিএফআইয়ের তত্ত্বাবধানে “জাতীয় নিরাপত্তা”র অজুহাতে একাধিক বিরোধী নেতা, ছাত্রনেতা ও মানবাধিকার কর্মীকে আটক করে গুম করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ
“রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে। কোনো ব্যক্তি বা পদমর্যাদা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” — বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার
আদালত আরও বলেন, “বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই অপরাধগুলোর বিচার অপরিহার্য।”
শেখ হাসিনার বর্তমান অবস্থান
গত বছরের জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে তিনি দিল্লির নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। তাঁর সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকও ভারতে রয়েছেন। আদালত তাঁদের সবাইকে পলাতক আসামি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে।
বিচারের প্রেক্ষাপট
অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে আগস্ট থেকে। সেই মামলাতেও শেখ হাসিনা প্রধান আসামি হিসেবে বিচারাধীন।
উক্ত মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, যেখানে রাজনৈতিক নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচালনার তথ্য উঠে আসে।
শাপলা চত্বরের ঘটনার তদন্তও শুরু
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের তদন্তও শুরু হয়েছে। ওই রাতে শতাধিক মানুষকে হত্যা ও গুমের অভিযোগ রয়েছে, যা তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে হয়েছিল বলে অভিযোগ।
একই সঙ্গে ২০১৮ সালের নির্বাচন-পূর্ব সময়ে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী নেতাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলোও নতুন মামলায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
“এটি ইতিহাসের মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এই পরোয়ানা তারই প্রমাণ।” — ড. জাফরুল্লাহ আহমেদ, আইনমন্ত্রী
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ। শেখ হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন না; তাঁর নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের পথে ছিল।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপকে “বাংলাদেশে মানবতার ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায়” বলে উল্লেখ করেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
আইন অনুযায়ী আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করতে হবে। তাঁরা অনুপস্থিত থাকলে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং পলাতক আসামি হিসেবেই বিচার চলবে।
রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে সাক্ষ্য দিতে সম্মতি জানিয়েছেন। প্রসিকিউশন মনে করছে, পর্যাপ্ত প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
দীর্ঘদিনের গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিচার শুরু হওয়ায় দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে।
এই বিচার প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে তা শুধু গুমের শিকার পরিবারগুলোর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে না, বরং ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা হিসেবেও কাজ করবে।