১৪ মাসে অর্ধেকে পুঁজিবাজার: নতুন কমিশনের হাতে বিনিয়োগকারীদের আশা
✍️
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা | অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে গত ১৪ মাসে নেমে এসেছে এক ঐতিহাসিক ধস। বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও মূল্য গড়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। অনেকেই তাদের মূলধনের বড় অংশ হারিয়ে হতাশ।
তবে জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার ও নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজারে আশার এক নতুন স্রোত বইছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেছে—এই নতুন নেতৃত্ব কি সত্যিই পুঁজিবাজারকে টেকসই ও স্থিতিশীল পথে ফেরাতে পারবে?
📉
১৪ মাসের বাজার ধস: আস্থাহীনতার চরম রূপ
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়টা বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন।
দীর্ঘ পতনের ধারা ও অনিয়মের অভিযোগে অনেকের বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে আসে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের মতে—
গত এক বছরে ২৪৩টি কোম্পানির মধ্যে ১৬৮টির দাম কমেছে, মাত্র ৪৭টির দাম বেড়েছে, আর বাকিগুলো প্রায় স্থবির অবস্থায়।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ—দুই বাজারেই সূচক পড়ে যায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
ছোট বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বাজার থেকে সরে গেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “লস মার্কেট” বা “ফাঁদ বাজার” কথাটাই এখন বেশি শোনা যায়।
⚙️
পতনের মূল কারণ: শুধু অর্থনীতি নয়, নীতির ব্যর্থতাও
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পতনের পেছনে একাধিক কারণ একসঙ্গে কাজ করেছে। নিচে সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
১️⃣ বিনিয়োগকারীর আস্থা ভেঙে যাওয়া
বাজারে স্বচ্ছতা না থাকায় ও তথ্য গোপনের কারণে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এক কোম্পানির পতনে অন্যদেরও বিক্রির প্রবণতা বাড়ে—ফলে বাজারে “প্যানিক সেল” তৈরি হয়।
২️⃣ পুরোনো কমিশনের নিয়ন্ত্রণহীনতা
পূর্ববর্তী কমিশনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল—
তারা ম্যানিপুলেশন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং “floor price” নির্ধারণ করে বাজারের প্রাকৃতিক প্রবাহ রোধ করেছে।
এই কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘমেয়াদে বাজারকে অকেজো করে দেয়।
৩️⃣ নীতিমালার দুর্বলতা
মার্জিন ঋণের বিধিমালা, কোম্পানির হিসাব প্রকাশ ও লেনদেনের স্বচ্ছতা—সবখানেই দুর্বলতা ছিল।
নতুন খসড়া নিয়মে বিনিয়োগকারীদের বছরে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার গড় বিনিয়োগ না থাকলে মার্জিন ঋণ না দেওয়ার প্রস্তাব ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও বাধা তৈরি করেছে।
৪️⃣ অর্থনৈতিক চাপ ও বৈদেশিক সংকট
মুদ্রাস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা—সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে নতুন পুঁজি আসছিল না।
অনেকে ব্যাংক সুদের হার বাড়ায় টাকা তুলে স্থায়ী আমানতে রাখেন।
৫️⃣ রাজনৈতিক অস্থিরতা
জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও তার পরের রাজনৈতিক পরিবর্তন বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষায় ছিলেন—নতুন সরকার কী করবে, নতুন কমিশন কতটা কার্যকর হবে।
🏛️
জুলাই আন্দোলন ও নতুন নেতৃত্বের আগমন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে ঘটে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। তাতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
তিনি দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনে “স্বচ্ছতা ও সংস্কার”-এর ঘোষণা দেন।
তার নেতৃত্বে গঠিত নতুন পুঁজিবাজার কমিশন (SEC) দায়িত্ব নেয় ২০২৫ সালের শুরুতে।
নতুন কমিশনের প্রথম লক্ষ্য—
“বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরানো, বাজারে স্বচ্ছতা আনা এবং অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।”
🔄
বাজারে পরিবর্তনের ছোঁয়া
নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেছে:
- বাজারে ধীরে ধীরে লেনদেন বাড়ছে,
- দীর্ঘদিন স্থবির থাকা শেয়ারের দাম সামান্য হলেও বাড়ছে,
- কমিশন দ্রুত তদন্ত ও রিপোর্ট প্রকাশ শুরু করেছে,
- এবং নতুন “ক্যাপিটাল মার্কেট রোডম্যাপ ২০২৬” প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক কর্মকর্তার ভাষায়—
“বাজারে এখন আস্থার আলো দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা অন্তত শুনছেন যে, এবার কমিশন আসলেই কাজ করছে।”
🌱
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাজার
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার এখন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে। সঠিক পদক্ষেপ নিলে আগামী ছয় মাসেই দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা সম্ভব।
নিচে কিছু সম্ভাবনামূলক দিক তুলে ধরা হলো:
✅ ১. নতুন আইন ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য নতুন আইনি কাঠামো তৈরি হচ্ছে। এতে ম্যানিপুলেশন ও ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে শাস্তি কঠোর করা হবে।
✅ ২. সরকারি কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি
সরকার নতুন করে বড় সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। এতে বাজারে নতুন পুঁজি ও আস্থা ফিরে আসবে।
✅ ৩. বৈদেশিক বিনিয়োগ ফেরানো
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে নিয়ম সহজ করা হবে, বিদেশি ফান্ড ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা আনার কথাও শোনা যাচ্ছে।
✅ ৪. বিনিয়োগকারীর শিক্ষা কর্মসূচি
বাজারে “বিনিয়োগ সচেতনতা অভিযান” চালু হচ্ছে—যাতে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকি ও কৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়।
✅ ৫. প্রযুক্তিনির্ভর লেনদেন ব্যবস্থা
পুরো ট্রেডিং সিস্টেমকে অটোমেশন ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি দিয়ে নিরাপদ করা হচ্ছে, যাতে অনিয়ম ও হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি না থাকে।
⚠️
তবে চ্যালেঞ্জ এখনো কম নয়
সব আশাবাদের মধ্যেও কিছু বড় ঝুঁকি রয়ে গেছে—
- রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি;
- নতুন কমিশনের অনেক সিদ্ধান্ত মাঠে বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরে;
- অর্থনৈতিক চাপ ও রিজার্ভ ঘাটতি বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে বাধা দিচ্ছে;
- অনেক কোম্পানি এখনও প্রকৃত আর্থিক বিবরণ প্রকাশ করছে না।
এক অর্থনীতিবিদের মন্তব্য—
“বাজারকে বাঁচাতে শুধু ঘোষণা নয়, ফলাফল দেখাতে হবে। নাহলে আবার আস্থার সংকট ফিরে আসবে।”
💡
করণীয় ও প্রস্তাবনা
১️⃣ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন: সব কোম্পানিকে বাধ্য করুন পূর্ণাঙ্গ হিসাব ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশে।
২️⃣ ছোট বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা দিন: মার্জিন ঋণের শর্ত সহজ করে দিন, ছোট বিনিয়োগকারীদের সুযোগ দিন।
৩️⃣ আইন প্রয়োগ করুন: বাজার ম্যানিপুলেটরদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ও জরিমানা দিন।
৪️⃣ নতুন সেক্টর যুক্ত করুন: আইটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহ দিন।
৫️⃣ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখুন: বাজার কখনোই স্থিতিশীল হয় না যদি নীতিগত অনিশ্চয়তা থাকে।
🔔
উপসংহার
১৪ মাসের অব্যাহত ধস বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
কিন্তু জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন কমিশন ও নতুন নেতৃত্বের আগমনে আবার আশার আলো জ্বলছে।
এই আশাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দরকার—স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
যদি নতুন কমিশন তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে, তাহলে খুব শিগগিরই বিনিয়োগকারীদের মুখে ফিরবে সেই পুরোনো আত্মবিশ্বাসের হাসি।