স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে সংখ্যালঘু উদ্বেগ: বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কঠোর প্রতিক্রিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা:
বাংলাদেশে সদ্য শেষ হওয়া শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে একটি বিতর্কিত ঘটনার জেরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাম্প্রতিক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এবারের দুর্গাপূজায় দেশের মোট ৭৯৩টি পূজামণ্ডপে অসুরের প্রতিমার মুখে দাড়ি আঁকার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আইনগত ব্যবস্থা, থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তদন্তের ঘোষণা দেন। তবে ঐক্য পরিষদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য
৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন—
“এবারের শারদীয় দুর্গাপূজায় সারাদেশের ৭৯৩টি পূজামণ্ডপে অসুরের মুখে দাড়ি লাগানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন, থানায় জিডি হয়েছে। এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমরা ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা চাইছি।”
এ বক্তব্য প্রকাশের পরপরই তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় ওঠে। সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর দাবি, এই বক্তব্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি তৈরি করেছে।
ঐক্য পরিষদের উদ্বেগ
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তাদের বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছে—
- দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে এমন বক্তব্য বিভাজন বাড়াবে।
- প্রতিমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও আয়োজকদের হয়রানি, মামলা-মোকদ্দমা কিংবা নিপীড়নের শিকার হতে হতে পারে।
- এটি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করবে, যারা দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা উল্লেখ করেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ঐতিহ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দুর্গাপূজার প্রতিমায় অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে নানা অবয়ব ব্যবহার হয়ে আসছে। দাড়িও তার একটি প্রতীকী অংশ, যার সঙ্গে নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতিমায় ‘অসুরের মুখে দাড়ি’ বিতর্কের পটভূমি
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব। তবে প্রায়শই পূজাকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি, গুজব ও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। এবারের পূজায় অসুর প্রতিমার দাড়িকে ঘিরে কিছু মহল অভিযোগ তোলে যে এটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রতীককে বিদ্রূপ করার চেষ্টা।
শিল্পীরা বলছেন, তারা বছরের পর বছর অসুরকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করে আসছেন। কারও লম্বা চুল, কারও দাঁত, কারও আবার দাড়ি—এসব প্রতীকী রূপকই অশুভ শক্তির প্রতিচ্ছবি, কারও ধর্মবিশ্বাসকে অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যকে “অযৌক্তিক” এবং “অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরোধী” বলে সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
অন্যদিকে, কিছু গোষ্ঠী মনে করছে, প্রতিমায় দাড়ি আঁকার বিষয়টি “সাংবেদনশীল” এবং ধর্মীয় উস্কানি এড়াতে শিল্পীদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
সংখ্যালঘু নেতাদের আশঙ্কা
ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ পর্যায়ে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়তে পারেন। অতীতে দেখা গেছে, পূজাকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার মতো নৃশংসতা ঘটেছে।
তাদের মতে, সরকারের দায়িত্ব হলো এই ধরনের অপপ্রচার রোধ করা এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু উল্টোভাবে যদি সরকারই আইনকে হাতিয়ার বানায়, তাহলে সংখ্যালঘুরা আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের মন্তব্য দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে দুর্বল করছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ভেঙে দিতে পারে।
ঐক্য পরিষদ সরকারকে অনুরোধ করেছে—
- সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিশেষ তকমা দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা বন্ধ করতে হবে।
- শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতাকে ‘অপরাধ’ বানানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশ দিতে হবে।
অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি আহ্বান
ঐক্য পরিষদ দেশের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা ও মানবিক শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছে—
“আমরা চাই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
এছাড়া তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানিয়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা কারণে এই সম্প্রীতি আঘাতের মুখে পড়ছে। শারদীয় দুর্গাপূজা বরাবরের মতো উৎসবমুখর হলেও এবারের ‘অসুরের মুখে দাড়ি’ বিতর্ক নতুন করে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিবৃতিতে স্পষ্ট সতর্কবার্তা রয়েছে—যদি এই ধরণের পদক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও অধিকার আরও বেশি হুমকির মুখে পড়বে।
সরকার কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে, সেটিই এখন সবার নজরে।