সোনার বাজারে নতুন রেকর্ড: ভরিতে দাম বাড়ছে প্রায় সাত হাজার টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা | বৃহস্পতিবার কার্যকর হচ্ছে নতুন দর

দেশের স্বর্ণবাজার যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। টানা কয়েক দিন ধরে একের পর এক দামের ঘোষণা আসছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে আবারও বাড়ছে সোনার দাম—এক লাফে ভরিপ্রতি প্রায় ৬,৯০৬ টাকা।

এই নতুন সমন্বয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২২ ক্যারেট খাঁটি (হলমার্ক করা) সোনার দাম ২ লাখ ৯ হাজার ১০১ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটাই হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সোনার দর।

বুধবার রাতে বাজুস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই নতুন দাম ঘোষণা করে জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে খাঁটি সোনার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

টানা মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন উচ্চতা

সোনার বাজারে এই উর্ধ্বগতি এক দিনের নয়। চলতি সপ্তাহেই চতুর্থ দফায় সোনার দাম বাড়ানো হলো। গত মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো দেশের বাজারে ভরিপ্রতি সোনার দাম দুই লাখ টাকা ছুঁয়েছিল। বুধবার পর্যন্ত ২২ ক্যারেট সোনা বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ১৯৫ টাকায়। বৃহস্পতিবার থেকে সেই দাম বেড়ে হচ্ছে ২ লাখ ৯ হাজার ১০১ টাকা।

নতুন দামে ২১ ক্যারেট সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৪ টাকায়, ১৮ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৩০১ টাকায়।

বুধবার পর্যন্ত যথাক্রমে এই দামগুলো ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪ টাকা, ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩১ টাকা ও ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭২ টাকা। অর্থাৎ, একদিনেই ২২ ক্যারেটে ৬,৯০৬ টাকা, ২১ ক্যারেটে ৬,৫৯০ টাকা, ১৮ ক্যারেটে ৫,৬৫৭ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতিতে ৩,০৫৬ টাকা বাড়ছে।

রুপার দামেও ঊর্ধ্বগতি

শুধু সোনাই নয়, রুপার দামেও দেখা দিয়েছে উর্ধ্বগতি। বাজুস জানিয়েছে, ২২ ক্যারেট রুপার নতুন দাম হবে ৪,৯৫১ টাকা ভরি, যা আগের চেয়ে ২৯৭ টাকা বেশি।

২১ ক্যারেট রুপা বিক্রি হবে ৪,৭৪৭ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৪,০৭১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির রুপার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩,০৫৬ টাকা ভরি।

এটি দেশের ইতিহাসে রুপারও সর্বোচ্চ দাম বলে জানিয়েছে জুয়েলার্স সমিতি।

কেন বাড়ছে দাম?

বাজুসের ভাষ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে খাঁটি বা তেজাবি সোনার দাম বেড়ে যাওয়াই এই বৃদ্ধির মূল কারণ। বুধবার পর্যন্ত বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম চার হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে—যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ডলারের শক্তিশালী অবস্থান এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে টানা দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশের বাজারও সেই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজুস প্রায় প্রতিদিনই দাম সমন্বয় করছে।

সোনার বাজারের সাম্প্রতিক চিত্র

মাত্র ২৬ মাস আগেও, অর্থাৎ ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সোনার দাম ছিল ভরিপ্রতি ১ লাখ টাকা। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই দফায় দফায় দাম বাড়তে থাকে।

২০২4 সালে একাধিক আন্তর্জাতিক সংকট—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রানীতি কড়াকড়ি এবং ডলারের অস্থিরতা—সব মিলিয়ে সোনার দাম এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

এখন দেশে প্রতি ভরিতে সোনার দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ, দুই বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার টাকা।

ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া

দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ ক্রেতারা যেমন চিন্তিত, তেমনি ক্ষুদ্র গহনা ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন।

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার এক স্বর্ণকার, সোহেল হোসেন বলেন,

“দাম বাড়লে ক্রেতা কমে যায়। মানুষ এখন গয়না কিনতে এসে কেবল দেখেই চলে যায়। অনেকে পুরনো গয়না বিক্রি করতে আসছে, কিন্তু নতুন কিনছে না।”

অন্যদিকে, বড় জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যতক্ষণ না কমে, স্থানীয় বাজারেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে না।

একটি নামী স্বর্ণালংকার কোম্পানির পরিচালক বলেন,

“আমরা নিজেরা ইচ্ছা করে দাম বাড়াই না। তেজাবি সোনার দাম বাড়লে আমাদেরও খরচ বেড়ে যায়। তবে ক্রেতারা যেন বিভ্রান্ত না হন, সেই জন্য স্বচ্ছ মূল্যতালিকা বজায় রাখা হচ্ছে।”

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সোনার দাম বাড়া অর্থনীতির একটি বড় ইঙ্গিত বহন করে। সাধারণত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা মুদ্রার মান কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনার দিকে ঝোঁকে।

অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন,

“সোনার দাম বৃদ্ধির মানে হলো বাজারে আস্থা কমে যাওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং যুদ্ধ–সংকট বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি এড়াতে বাধ্য করছে। তাই সোনার দাম বাড়া আশ্চর্যের নয়।”

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে, কারণ আমদানির ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি।

বিনিয়োগ ও বাজারে সম্ভাব্য প্রভাব

বিনিয়োগকারীরা এখন সোনাকে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছেন। শেয়ারবাজারের অস্থিরতা, ব্যাংক সুদের হার ওঠানামা এবং ডলারের সংকটের কারণে অনেকেই সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।

তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি টেকসই নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য স্থিতিশীলতা এলে স্থানীয় দামও কিছুটা কমে আসতে পারে।

একই সঙ্গে সরকার যদি সোনা আমদানিতে নীতিমালা পরিবর্তন বা শুল্ক ছাড় দেয়, তাহলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে এবং দাম কিছুটা কমতে পারে।

সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব

সোনার দাম বাড়ার প্রভাব সরাসরি পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনে। বিয়ে, উপহার বা ধর্মীয় উৎসব—সবক্ষেত্রেই সোনা একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ। এখন অনেকেই সোনার পরিবর্তে রুপা বা হালকা ডিজাইনের গয়না কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

চট্টগ্রামের গহনা ব্যবসায়ী মনোয়ারা বেগম বলেন,

“আগে যেখানে বিয়েতে দুই ভরি সোনা কিনতো, এখন সেখানে আধা ভরি কিনছে। দাম এত বেড়ে গেছে যে অনেকেই শুধু প্রতীকী কিছু নিচ্ছে।”

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক সপ্তাহ আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে। যদি মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাতে দেরি করে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি সোনায় ঝুঁকবে।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হলে এবং ডলারের মান কিছুটা স্থিতিশীল হলে দাম কিছুটা কমে আসতে পারে।

বাজুসের কর্মকর্তারা বলছেন,

“আমরা প্রতিদিন আন্তর্জাতিক দামের ওপর নজর রাখি। দাম বাড়লে বা কমলে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিই। বাজার স্থিতিশীল থাকলে আমরা আর দাম বাড়াব না।”

সারসংক্ষেপ

এক কথায় বলা যায়, দেশের সোনার বাজার এখন রেকর্ড গড়ার পথে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ভরিপ্রতি সোনার দাম ১ লাখ টাকার নিচ থেকে বেড়ে ২ লাখ ৯ হাজার টাকায় পৌঁছেছে।

এই ঊর্ধ্বগতি শুধু গহনা ব্যবসা নয়, পুরো অর্থনীতিতেই নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। ক্রেতারা যেখানে চিন্তিত, সেখানে ব্যবসায়ীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *