🇧🇩 বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভাঙার খেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা

কীওয়ার্ড: বাংলাদেশের অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট, ব্যাংক খাত, রপ্তানি আয়, অর্থনৈতিক সংকট

🔥 এক সময়ের দৃঢ় অর্থনীতি এখন সংকটের ঘূর্ণিতে

বাংলাদেশ একসময় দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত ছিল। দ্রুত প্রবৃদ্ধি, রপ্তানিতে সাফল্য, ও দারিদ্র্য হ্রাস—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ছিল শক্ত অবস্থানে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই সাফল্যের ধারা যেন ধসে পড়েছে। ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা, এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিনির্ভরতা—সব মিলিয়ে অর্থনীতির মেরুদণ্ড এখন চরম দুর্বল অবস্থায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি নয়; দীর্ঘদিনের নীতিগত ভুল, অনিয়ন্ত্রণ ও স্বজনপ্রীতি আজ দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

💰 বৈদেশিক রিজার্ভে ভয়াবহ পতন

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ১৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে—যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো সম্ভব নয়।

অর্থনীতিবিদ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন,

“আমরা রপ্তানি আয় বাড়াতে পারিনি, রেমিট্যান্সেও ধস নেমেছে। অথচ বিলাসী আমদানি ও খরচ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ফলেই আজ ডলার বাজারে অস্থিরতা।”

📈 মুদ্রাস্ফীতির দগদগে ক্ষত: সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ

খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। চাল, তেল, ডাল, পেঁয়াজ—সবকিছুর দাম আগুন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.৩১ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঢাকার গৃহিণী রওশন আরা বলেন,

“আগে মাসে ১৫ হাজার টাকায় বাজার চলত, এখন ২৫ হাজারেও কুলায় না। সবকিছু হাতের বাইরে চলে গেছে।”

অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানে গভীর প্রভাব ফেলছে।

🏦 ব্যাংক খাত: দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ ও আস্থাহীনতা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা।

রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি এই খাতকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন,

“ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। বিনিয়োগ কমছে, ফলে কর্মসংস্থানও কমছে।”

🏭 রপ্তানি ও শিল্পখাতে স্থবিরতা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) একসময় ছিল অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু এখন সেই খাতে প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি আয় ৮.৪ শতাংশ কমেছে।

বিজিএমইএর তথ্যমতে, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে অর্ডার কমেছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন,

“বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অনিশ্চয়তা এবং নীতিগত অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে।”

💸 বাজেট ঘাটতি ও ঋণনির্ভর অর্থনীতি

সরকারের ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে জিডিপির প্রায় ৫.২ শতাংশে।

এই ঘাটতি পূরণে সরকার এখন ক্রমেই বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।

অর্থনীতিবিদ ড. ফারাহ নাজ ইসলাম বলেন,

“ঋণ নেওয়া সমস্যা নয়, কিন্তু সেই ঋণের সঠিক ব্যবহার না হলে এটি অর্থনীতিকে ফাঁদে ফেলবে।”

🌍 ডলার সংকটে আমদানি বিপর্যয়

ডলার সংকটের কারণে শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানিতে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে এলসি (LC) খোলার অনুমোদন বিলম্বিত হচ্ছে, ফলে উৎপাদন ও সরবরাহ উভয়ই ব্যাহত হচ্ছে।

ফলে বাজারে পণ্যের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে এবং দাম আরও বাড়ছে—এ যেন এক দুষ্টচক্র।

📉 বৈদেশিক বিনিয়োগে ধস

একসময় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ ছিল আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু এখন প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্নীতি ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে FDI (Foreign Direct Investment) প্রায় ২৭% কমে গেছে।

বিডা (BIDA)-এর এক কর্মকর্তা জানান, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বা ভারতে ঝুঁকছেন।

⚖️ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতির আরেক বিপদ

নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয় সৃষ্টি করছে।

একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী বলেন,

“আগামী ছয় মাসে কী হবে আমরা জানি না। তাই নতুন কোনো বিনিয়োগে ঝুঁকি নিচ্ছে না কেউ।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব।

👪 সামাজিক প্রভাব: মধ্যবিত্তের দুঃসহ জীবন

মূল্যস্ফীতি ও আয় হ্রাসের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

ঢাকার এক স্কুলশিক্ষক বলেন,

“আগে মাসে কিছু সঞ্চয় করতে পারতাম, এখন মাস শেষ হলেই ধার করতে হয়।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পতন মানে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।

✅ করণীয় ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

অর্থনীতিবিদদের মতে, এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে বাংলাদেশ এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়বে। তাদের প্রস্তাবগুলো হলোঃ

1. রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি: নতুন বাজার খোঁজা ও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো।
2. অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ: বিলাসী পণ্যের আমদানি সীমিত করা।
3. ব্যাংক খাতে সংস্কার: দুর্নীতি বন্ধ ও খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা।
4. বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে বিনিয়োগ: টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
5. নীতি ও প্রশাসনে স্বচ্ছতা: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন,

“বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও পুরোপুরি ধসে পড়েনি, কিন্তু এটি গভীর সংকটে আছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে পুনরুদ্ধার খুব কঠিন হয়ে যাবে।”

🔚 উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট শুধু পরিসংখ্যানের বিষয় নয়; এটি এখন মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র।

বাজারের আগুন, আয় কমে যাওয়া, বেকারত্ব, ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সত্যিই ভেঙে পড়ার পথে।

এই “মেরুদণ্ড ভাঙার খেলা” বন্ধ না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার চড়া মূল্য দিতে হবে।